Not College Street, Kolkata’s oldest bookstore was Battala
কলকাতা
দ্যা হোয়াইট বাংলা ডিজিটাল ডেস্ক : কলকাতা নতুন যতই হোক উত্তর কলকাতার বহু রাস্তা আজও থমকে আছে কোনও এক নির্দিষ্ট সময়কালে। মাল্টিপ্লেক্স, স্মার্টফোন, স্কাই-হাই অ্যাপার্টমেন্টে আপাদমস্তক কলকাতাকে ঢাকলেও নব্য কলকাতাকে চোখ রাঙিয়ে আজও বেঁচেবর্তে আছে আদি কলকাতার পুরনো গল্পেরা। নষ্ট্যালজিক সময় যেন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখার জন্যে। ফুটবল, ক্রিকেট, আড্ডা ছাড়াও উত্তর কলকাতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে পড়ে বইপড়া। মহাকালের অমোঘ নিয়মে অনেক বইয়ের দোকান হারিয়ে গেছে তালিকা থেকে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রাচীন অশ্বত্থের মত টিকে আছে কয়েকটি লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার। এর মধ্যে অন্যতম হলো ডায়মন্ড লাইব্রেরি।আদতে এটি একটি দোকান। যার বয়স নেই নেই করেও দেড়শো বছরের কাছাকাছি।
উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোড রবীন্দ্র সরণীর ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই হয়তো খবর রাখেন না যে তাঁরা কলকাতা শহরের অন্যতম প্রাচীন সরণী ধরে চলছেন। যাত্রাপাড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ যাত্রাদলের দোকানের ভিড়ে চোখ চলে যাবে সুপ্রাচীন ওই দোকানের দিকে। কাঠের ফ্রেমে সাজানো বই গুলি। দোকানে ভিড় নেই। উৎসাহিত কয়েকজন মাঝেসাঝে উঁকিঝুঁকি মারছেন। ফুটপাথের ধারে দোকানটি দেখলে যেন মনে হয় বৃদ্ধ বয়সের ভারে নুইয়ে পড়ছে।
এই শহর তৈরি হওয়ার সময় থেকে কলকাতার ধমনীতে যা জড়িয়ে আছে তা হল ছাপাখানার যন্ত্র। কলেজস্ট্রিটের বই পাড়া নিয়ে আজও হইহুল্লোর। তবে জেনে রাখা দরকার এই শহর কলকাতার বইপাড়া আদি পীঠস্থান ছিল আজকের চিৎপুরের হারিয়ে যাওয়া বটতলার বইপাড়া।
শোভাবাজার মোড় থেকে রবীন্দ্র সরণির উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে প্রসারিত রাস্তা। বলতে গেলে, এখান থেকেই বাঁ-হাতি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করলে সেকালের ‘বটতলা’ এলাকা শুরু। আরও সহজ করে বললে এখান থেকে শুরু যাত্রাদলের দোকান। আঠারো শতকের শেষ দিকে এই এলাকাতেই ছোটখাটো ছাপাখানা গজিয়ে ওঠার সুবাদে ছাপা শুরু হয়েছিল নানাবিধ ধর্মীয়, গল্প, উপন্যাস, রম্য রচনা, নাটক ও সমাজধর্মী প্রহসন এবং আদিরসাত্মক পু্স্তকাদি। তাই ছাপাখানা যখন এল তখন ওই সব বিষয়ে বিবিধ পুস্তক পাইকারি ও খুচরো বিক্রির কেন্দ্র হিসাবে এই বটতলাই ছিল কলকাতার আদি বইপাড়া। সেকালের মতো অত বইয়ের দোকান আর নেই। তবুও যে’কটি দোকান আছে তার মধ্যে ডায়মন্ড লাইব্রেরি । আজও পুরনো বইগুলো নিয়েই আঁকড়ে ধরে আছে। এই দোকানের শুরুটাও হয়েছিল পাতলা চটি বইয়ের হাত ধরে। কাঠখোদাইয়ের বটতলা, ছেনিকাটা হরফে সস্তার কাগজে। রম্য রচনা রসাত্মক গল্প। পরবর্তীতে এসব বই ছাপানো বন্ধ করে যাত্রার বই এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ছাপানো শুরু করে। ডায়মন্ড লাইব্রেরীর বর্তমান কর্ণধার বৈদ্যনাথ শীল বলছিলেন “এই দোকানের বয়স প্রায় ১৪৬ বছর। তখনকার দিনের সাহিত্য এত উন্নত ছিল না। অন্যধরণের সব বই প্রকাশিত হত।
১৮২৪ বঙ্গাব্দের স্থাপিত দোকানে কাঠের ধুলো পড়া শোকেজে আজও উঁকি দেয় যাত্রার বই আর গৃহস্থের গ্রন্থাবলী। কানাইলাল শীলের গো-পালন বিষয়ক বইও আজ দুর্লভ। এই বই গুলো দেখলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো কলকাতার গ্রামীণ চেহারা। বৈদ্যনাথবাবু বলেন, এক বছর অভিনয় হয়ে যাওয়ার পর মঞ্চে আর সেই যাত্রা অভিনয় করা যেত না। তখন লেখকরা যাত্রা অভিনয়ের সে সব স্ক্রিপ্ট বিক্রি করে দিতেন আমাদের কাছে। আমরা যাত্রার স্ক্রিপ্টগুলো বই হিসেবে প্রকাশিত করতাম। আমাদের এখানে যাত্রার নামজাদা সব লেখকরা তাঁদের বই ছাপাতে দিয়ে যেতেন। আগেকার লেখকদের মধ্যে ব্রজেন্দ্র কুমার দে, প্রসাদ কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, নির্মল মুখার্জী। এখন তো যাত্রার বাজার শেষ সরকার আর সেরকম স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসে না বই ছাপানোর জন্যে। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর আগ্রহী নই এই ব্যবসায় আসতে। সকলে পড়াশুনা শিখে এখন চাকরি করছে। সরকারের উচিত আমাদের নিয়ে ভাবা।
আঠারো শতকের শেষ দিকে এই এলাকাতেই ছোটখাটো ছাপাখানা গজিয়ে ওঠার সুবাদে ছাপা শুরু হয়েছিল নানাবিধ ধর্মীয়, গল্প, উপন্যাস এবং আদিরসাত্মক পুস্তকাদি। তাই ছাপাখানা যখন এল তখন ওই সব বিষয়ে বিবিধ পুস্তক পাইকারি ও খুচরো বিক্রির কেন্দ্র হিসেবে তৈরি ডায়মন্ড লাইব্রেরীর মতন এসব দোকানগুলো। সময়ের নিয়মে একের পর এক দোকানে ঝাঁপ পড়েছে। ডায়মন্ড লাইব্রেরীও বয়সের বাড়ার সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছে। হারিয়েছে পুরনো সব জৌলুস। ইতিহাসের সরণি ধরে হাঁটতে বেরোলে চিৎপুররের রাস্তাতেই হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে বটতলার এই বইয়ের দোকানের সঙ্গে। রঙ বেরঙের যাত্রার পোস্টারের ভিড়ে একলা মুখ বুঝে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন এই দোকান।